Loading...
The Financial Express

রেট্রোফাইল: যারা ভালোবাসেন অতীতকে

| Updated: September 05, 2022 21:32:37


ছবি: পিক্সাবে ছবি: পিক্সাবে

যুগের হাওয়া যেদিকে বয়, মানুষের জীবনপ্রবাহ সেদিকেই ধায়। সময় নদীর মতন বহমান। ধেয়ে চলতে চলতে স্রোতে ভেসে কিনারায় রেখে যায় নানা সম্পদ। আর এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা সময়ের ফেলে রাখা জিনিস বুকে আগলে রাখতে ভালোবাসেন। আজকের পরিভাষায় এদেরকে বলা হয়, রেট্রোফাইল বা পুরাতনপ্রেমী। এরা পুরানো দিনের বস্তু পুঁজি করতে পছন্দ করে। এখানে পুরানো জিনিস বলতে হতে পারে কোনো আচার, হতে পারে গান বা হতে পারে নিছক নিত্যব্যবহার্য কিছু।

বাঙালি রেট্রোফাইলরা ঐতিহ্যপ্রেমী। তাদের জীবন সংগীতে শুনতে পাওয়া যাবে পুরানো দিনের গল্প। এমন নয় যে তারা যেই সময়টাতে বাস করেন সেটাতে ভ্রূক্ষেপ করছেন না। কিন্তু আধুনিকতার সাথে বাঁচিয়ে রেখে চলছেন পুরাতনকে।

এদের সবেতে আছে বিশেষ যত্ন। যেন হারাতে দেয় না কিছুই। সেকেলে পারিবারিক জিনিসগুলো বংশানুক্রমে যত্নে সংরক্ষণে রাখেন যুগ ধরে। আর যদি সেদিনের প্রয়োজনীয় কিছু একেবারেই হাতের কাছে না পান, তাহলে গড়ে নেন নিজের হাতেই। বাড়ির উৎসবগুলো পালনে ধরে রাখেন সাবেকিয়ানা। সেই মতো করেন অতিথি আপ্যায়ন। অতিথিদের পাতে পরে পারিবারিক ঐতিহ্যের রান্না। প্রাচীন স্বাদের চাটনি আর পিঠে-পুলি। শেষ পাতে বাদ যায় না হাতে পাতা দই আর সন্দেশ।

এরা পুরাতনে খুঁজে পায় নান্দনিকতা। ভাঙা পাঁচিলের গায়ের ঝরে পড়া নকশাটি মনে পুলক জাগায়। তাই বেড়াতে যেতে ভালোবাসে পুরানো মহল, প্রাসাদ কিংবা জাদুঘরে। প্রায়শই যাতায়াত তাদের এন্টিকের দোকানে যেখানে নানা যুগের হারানো জিনিস গড়েছে ঠাঁই।

ভুরি ভুরি টাকা লুটিয়ে হলেও সেখান হতে রুচি মিলিয়ে ঘরে তুলে নিয়ে আসে অনন্য সব জিনিসপাতি। পুরানো বাক্স বা তোরঙ্গ। ঘরের সিলিংয়ে ঝাড়বাতি। দেয়ালে আগের দিনের ভিন্টেজ সব চিত্রকর্ম। তার ফ্রেমগুলোতে চোখে লেগে থাকার মতো কাঠের কারুকাজ। তার পাশেই দাদাসাহেবের ঘড়ি, ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং শব্দ।

শোপিসে পুরানো দিনের নানান রকম পুতুল, চিনে মাটির মডেল, হারিয়ে যাওয়া দিনের কিউরিও। শেলফে অনেক দিনের বই ঠাসা। ঘরের এককোণে ফুলদানিতে সাজানো কিছু তরতাজা ফুল। আরেক কোণে ল্যাম্পশেডের মৃদু আলো। খাবারঘরে বাসনপত্রে কাঁসা-পিতলের ঝনঝনানি আর চিনে মাটির  পাত্রের সাবধানতা। আর উঠোন জোড়া শখের ফুলের বাগান। এমনই হয় পুরাতনপ্রেমীর গৃহের আবহ। 

কেউ কেউ এখনো ভালোবাসেন চিঠি লিখতে অথবা প্রিয়জনের কাছ থেকে চিঠি পেতে। অনেকে আবার ভালোবাসেন পুরাতন গান বা ক্লাসিক্যাল মিউজিক। সকালটা মিষ্টি করে শুরু হয় কলের গান বা রেডিও গানে ধোঁয়া ওঠা ইংলিশ চায়ের চুমুকে। আবার কেউবা নিজেই বেহালা, সেতার, তানপুরা, বীনা, এস্রাজ কিংবা হারমোনিয়ামে তোলেন রবি, দ্বিজেন, রজনী আর নজরুলের সুর।

পুরাতনীরা সাজতে ভালোবাসে ঐতিহ্যবাহী কায়দায়। নারী হলে বাহারি সেলাই তোলা জামার মতো লেস দেয়া ব্লাউজ, সাথে সেকেলে নকশাদার শাড়ি গায়ে চাপায়।

পুরুষের পছন্দ বাঙালির চিরচেনা পোশাক ধুতি পাঞ্জাবি আর চাদর। মেয়েরা সাজে কাজল টানে আর নকশা কাটা হার-দুলে। পায়ে নুপুরের শিঞ্জনের সাথে আলতার লালিমা। কপালের মাঝে চাঁদের মতো কুমকুমে আঁকা টিপ। নারী হোক কিংবা পুরুষ কেউই ভুলে যান না  চন্দন বা কাঁচা বেলির আতরের গন্ধ ছোঁয়াতে।

এমনই একজন রেট্রোফাইল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুরাধা চক্রবর্তী। যিনি আধুনিক সময়ে থেকেও পছন্দ করে হারানো দিনের জীবনশৈলী। তিনি সব থেকে বেশি পছন্দ করেন নিজেকে পুরানো দিনের মতো সাবেকি ধাঁচে সাজাতে। শাড়ি তার ভারী পছন্দের। সেকেলের চিরঞ্জীবিনী  নায়িকাদের অনুকরণ করে তিনি সাজেন।

শর্মিলা ঠাকুর আর সুচিত্রা সেনের মতন করে ভারী টানে কাজল তোলেন চোখে, কপালে উঁচু করে টিপ পড়েন। খোঁপায় গুঁজে দেন ফুল। রুপালি রঙের গয়নায় তার চোখ চলে যায় বেশি। টানা দেয়া ঝুমকা, চুড়ি, চিক, নুপুর- খুব যত্নে থাকে গয়নার বাক্সে। এগুলো তিনি সংগ্রহ করেন মৌচাক মার্কেট, অথবা কোনো শখের অনলাইন শপ হতে।

নিজের সাবেকি প্রেম নিয়ে বলেন, "আমি পুরানো দিনের গান খুব পছন্দ করি। মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আর দেশের সুবীর নন্দী আর সাবিনা ইয়াসমিনের গান খুব মন কাড়ে। মন খারাপের সময় ওইসব গান শুনলে অনেকখানি হালকা লাগে। আজকের মর্ডান কৃষ্টি থেকে সেই কালের সংস্কৃতি পরায়ণতা আমাকে বেশি টানে।"

অনুরাধা খুব রুচি নিয়ে ঘর সাজান। তার গৃহকোণের আল্পনা নিজে হাতে করেন। ঘরের দোরে ঝুলিয়ে রাখেন শোলার কদমফুল। জানালাতে সাদামাটা রঙের পর্দা, আর ঘর জুড়ে তার ধূপের সুবাস। যামিনী রায়ের আঁকা আর সেকেলে পটচিত্র অনুরাধার খুব প্রিয়। টানিয়ে রাখতে চান দেয়ালে। অনুরাধা বলেন, "আমার একটা শখ আছে; একদিন একটা পুরানো ধাঁচের বাড়ি কিনে সেখানটায় থাকবো।"

সংখ্যায় এন্টিকপ্রেমীরা ভারী অল্প হলেও এদের জন্য পীঠস্থান বলতে হয় গুলশান-২ এর ডিসিসি মার্কেট এর দ্বিতীয় তলাকে, যাতে সারি সারি করে পসরা বসিয়েছে আভিজাত্য। এগুলোর মধ্যে আলম হ্যান্ডিক্রাফট, হোসেন হ্যান্ডিক্রাফট ও সোহাগ হ্যান্ডিক্রাফটে পাওয়া যাবে গ্রামোফোন, চাবি দেয়া ঘড়ি, ধাতব দুরালাপনী, কম্পাস, লাম্পশেড, আতরদান, হুঁকো, সুরুয়ার পাত্র হতে শুরু করে দূর্লভ সব বস্তু।

বিস্তার এর শোরুম, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, ঢাকা। ছবি: বিস্তারের ফেইসবুক পেইজ হতে সংগৃহীত

কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের বিস্তার দোকানটিও নেহায়েত কম যায় না, অমূল্য সব সংগ্রহ। এছাড়া ধামরাইয়ের সুকান্ত মেটাল ক্রাফটস এখনো তৈরি করে থাকে ধাতব নির্মিত পুরানো নকশার নানা ব্যবহার্য বস্তু ও ভাস্কর্য। 

যদি কেউ পুরাতন আসবাবের খোঁজ করে থাকে তবে তার জন্যে অবশ্য গন্তব্য খিলক্ষেতের অনিক ইউনিক কালেকশন নতুবা বারিধারার ভিন্টেজ ফার্নিচার। তবে এসবের ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্য যেটি, হারিয়ে যাওয়া জিনিস তো, তাই কড়িটা একটু বেশিই ফেলতে হবে। তবে কিনা শখের তোলা আশি টাকা!

পুরাতনীরা দিলখোলা। সোনালী অতীতকে নিয়ে তাদের অনেক ভালোবাসা। শুধু বাঙালি নয়, পৃথিবীর যেকোনো কৃষ্টিতেই নস্টালজিয়া বিলাসী এই রেট্রোফাইলদের বিচরণ। তারা সকলেই নিজস্ব কায়দায় ধরে রেখেছেন সংস্কৃতিকে। এদের মাঝে হারানো পৃথিবী যেন খুব সহজে দেখতে পাওয়া যায়।

এরকম জীবনশৈলীতে সেকালে যারা ছিলেন আধুনিকা, একালে তারা পুরাতনী। কেমন করে চলতেন শতবছর আগের আধুনিকরা, সেটি চোখের সামনে এদের হাঁটাচলায় আন্দাজ করা। এরা কেউই পিছিয়ে নন মানসিকতাকে, বরং এদের রুচি নান্দনিক, চিন্তাধারা পরিশালিত। আছে গভীর জীবনবোধ। একটা হারিয়ে যাওয়া সময়কে ধরে রেখেছেন মায়া দিয়ে।

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

susmi9897@gmail.com

Share if you like

Filter By Topic