Loading...
The Financial Express

যন্ত্র বনাম মানুষ, উপলক্ষ্য দাবা


যন্ত্র বনাম মানুষ, উপলক্ষ্য দাবা

মানসিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা এবং জটিল চিন্তা করতে পারার এক অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে দাবা খেলা সবার কাছেই পরিচিত। ৮ম শতাব্দীতে ভারতে উদ্ভাবিত হওয়ার পর থেকে সাদা-কালোয় ৬৪ ঘরে রাজ্যপাট বসিয়ে হয়ে আসছে চিন্তার লড়াই। সময়ের সাথে এর আবেদন বেড়েছে, নিত্যনতুন কলা-কৌশলে সাদা-কালো দাবা হয়ে উঠেছে আরো রঙিন। অথচ বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই দাবার অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছিল ডিপ ব্লু নামের সুপার কম্পিউটার, প্রশ্ন উঠেছিল মানুষের টিকে থাকা নিয়েও। 

এই গল্পের শুরুটা জানতে হলে যেতে হবে আরেকটু পেছনে। ১৯৮৫ সাল। সোভিয়েত যুবক গ্যারি কাসপারভ তখন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে হয়েছেন বিশ্বসেরা। জার্মানির হামবুর্গে দাবাড়ু হিসেবে অসামান্য মেধাবী কাসপারভকে দাবা খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে বলা হয় মানুষের বিরুদ্ধে দাবা খেলতে পারা কম্পিউটারের সাথে। 

দাবার বোর্ডে জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত কাসপারভ এই চ্যালেঞ্জ শুধু নিলেন, এটা বললে কম বলা হবে। কাসপারভ চাইলেন ৩২ টি কম্পিউটারের সাথে খেলতে। রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে একে একে ৩২টি কম্পিউটারের সাথেই খেললেন কাসপারভ এবং ৫ ঘণ্টা ধরে খেলা চলার পর সবগুলো কম্পিউটারকেই হারাতে সক্ষম হলেন। 

এদিকে মানুষের সাথে দাবার লড়াইয়ে জয়লাভ করতে পারে এমন কম্পিউটার বানানোর প্রচেষ্টায় ১৯৮০ দশকেই কার্নেগি-মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তৈরি করেছিলেন ডিপ থট নামক কম্পিউটার। একজন গ্রান্ড মাস্টারকে হারিয়ে দেয়ার পর বেশ সাড়ে ফেলে দেন তারা। কিন্তু কাসপারভের সাথে দুই গেমের খেলায় হেরে যায় ডিপ থট। ডিপ থটের পুরো আইডিয়াটাই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করে উপযুক্ত পরিবেশ, প্রয়োজনীয় অর্থ এবং গবেষণাগারের ব্যবস্থা করে অনেক বেশি উন্নত দাবাড়ু কম্পিউটার নির্মাণের লক্ষ্যে নিজেদের গবেষক দলে ওই শিক্ষার্থীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে আইবিএম। আর তার ফলাফলে নির্মিত হয় সুপার কম্পিউটার ডিপ ব্লু। 

১৯৯৬ সালে কাসপারভ ও ডিপ ব্লু-এর মধ্যে ৬ ম্যাচের টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় এবং প্রথম ম্যাচেই হেরে গেলেন কাসপারভ। সবার তো মাথায় হাত, কারণ কাসপারভের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নের সাথে কম্পিউটারের বিপ্লবের গল্পেরও পাওইয়া যাচ্ছিল আভাস। কিন্তু কাসপারভ দাপুটে প্রত্যাবর্তন করলেন পরের ম্যাচেই। শেষ পর্যন্ত জয় ও ড্র মিলিয়ে ৪-২ এ ডিপ ব্লুকে হারিয়ে দিয়েছিলেন গ্যারি কাসপারভ।

গ্যারির বিজয়ে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও শান্তি পাচ্ছিলেন না আইবিএমের গবেষক দল। ডিপ ব্লুর দেয়া চালগুলোর মধ্যে থেকে তারা খুঁজে বের করতে থাকলেন ছোটোখাটো ভুল। সেগুলো ঠিকঠাক করা হলো। দাবা খেলার জন্য তৈরি করা হলো বিশেষ চিপস, কার্যক্ষমতা করা হলো দ্বিগুণ। শুধু শুরুর চাল ঠিকভাবে দেয়ার জন্য একজন গ্রান্ড মাস্টারকে সাথে নিয়ে তৈরি হয় আলাদা এক লাইব্রেরি। এই দ্বিতীয় সংস্করণের ডিপ ব্লু প্রতি সেকেন্ডে ১০০-২০০ মিলিয়ন চাল বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো।

১৯৯৭ তে এসে দ্বিতীয় সংস্করণের ডিপ ব্লু এবং গ্যারি কাসপারভকে আবারও দেখা গেল দাবার বোর্ডে। এইবারের খেলা নিয়ে বিজ্ঞাপনের পসরা সাজানো হয়। রেডিও ও টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় খেলার অবস্থা। পত্রিকার পাতায় এমন সব চটকদার শিরোনামে ছাপানো হচ্ছিল এই খেলার খবর, যাতে মনে হয় কাসপারভ দাবায় হেরে গেলেই বুঝি হয়ে যাবে সভ্যতার শেষ। 

নিউ ইয়র্কে ১৯৯৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া ৬ ম্যাচের টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে বেশ হেসে খেলেই জিতে যান গ্যারি কাসপারভ। দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে শুরু হলো নাটকীয়তা। কম্পিউটারকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেই আটকে যান গ্যারি । আগের অভিজ্ঞতা থেকে গ্যারির ধারণা ছিল কম্পিউটার কখনোই কোনো ঘুঁটি হারাতে চায় না। তাই ডিপ ব্লুর সামনে এমন চাল দিয়েছিলেন গ্যারি, যেখানে ডিপ ব্লুকে হয় রাজাকে এক ঘর পেছনে নিতে হবে, অথবা নিজের সৈন্য বিসর্জন দিতে হবে। 

কিন্ত সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৈন্য খুঁইয়ে দেয় ডিপ ব্লু। আর এই ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়ে মাত্র ১০ চাল পরেই পরাজয় মেনে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যান গ্যারি। অথচ ঐ খেলা তখনও তার নিয়ন্ত্রণেই ছিল। 

বাকি চার ম্যাচে কাসপারভের প্রত্যাবর্তন আর হয়ে উঠলো না। প্রথম তিনটিতে ড্র করে, শেষ ম্যাচে শোচনীয়ভাবে হারলেন ডিপ ব্লুর কাছে। ৩.৫-২.৫ পয়েন্টে টুর্নামেন্ট জিতলো ডিপ ব্লু। ক্যামেরার মাধ্যমে সারা পৃথিবী দেখলো যন্ত্রের সামনে গ্যারি কাসপারভের অসহায়ত্ব। রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে যায় ডিপ ব্লু। শেয়ার বাজারে আইবিএমের স্টকের মূল্য ৩.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যন্ত্র যে মানুষকে হারাতে পারে, শুধু এটুকুই প্রমাণ করতে চেয়েছিল আইবিএম। তাই কাসপারভকে হারানোর পর তারা আর আগায়নি ডিপ ব্লুকে নিয়ে। এমনকি কাসপারভ আরো একটি টুর্নামেন্ট খেলতে চেয়েছিলেন, সেই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি আইবিএম। 

মজার বিষয় হচ্ছে, যে অসাধারণ চালের কারণে খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন কাসপারভ, সেই চাল এসেছিল একটি কম্পিউটার বাগ বা কোডের ভুল থেকে। ওই মুহূর্তে যেকোনো চালই দিতে পারতো ডিপ ব্লু, সৈন্য খোয়ানোটা নিতান্তই কাকতালীয়।  ২০১২ তে এসে আইবিএমের গবেষক দলের একজন এমনটিই জানান। তবে শুধু যে ভাগ্যের জোরেই সেদিন ডিপ ব্লু জিতেছিল এমনটা বলা যায় না। কারণ ওই ম্যাচের পরই এই ভুল শুধরে দেয়া হয়। 

১৯৯৭ সালে ডিপ ব্লু জিতেছিল মানুষের বিপক্ষে। পেরিয়ে গেছে ২৬ বছর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষ ছাপিয়ে গেছে অনেক কিছুকেই। মানুষের মতো করে যন্ত্রকে ভাবতে শেখানোর চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে পরাজিত করে যন্ত্র বিশ্বকে শাসন করবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তবু, প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রায় ডিপ ব্লু থেকে যাবে এক অমর নাম হিসেবেই। 

 

সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic