মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বিরিয়ানীর গলিটি অনেকেরই পরিচিত। গলিটি ধরে এগিয়ে গেলে সবার আগেই পাওয়া যায় 'ফায়জানে মদিনা হাউস' বা বোবার বিরিয়ানী। তবে গলিতে না ঢুকে ডানদিকে তাকালে দেখা যাবে নানারকম কাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে কয়েকটি দোকান। এর ভেতর আছে শওকত চাপ ঘর ও নামবিহীন আর দুটি দোকান। গলি বরাবর বিপরীতে থাকা দোকানটিই হলো মনসুর কাবাব।
নাম বা সাইনবোর্ডবিহীন দোকানটিকে সবাই চেনে একনামেই। দোকানের সামনে এলেই দেখতে পাবেন মসলা দিয়ে মেরিনেট করে রাখা হয়েছে শিক কাবাব, চিকেন চাপ, আলু শিক, ড্রামস্টিক, উইংস ও শামী কাবাব। দাম অনেকেরই নাগালের মধ্যে। শিক কাবাব ৩০ টাকা, চিকেন চাপ ছোটটি ৬০ ও বড়টি ৯০ টাকা। আলুর শিক ১০ টাকা প্রতিটি। উইংস ৩০ ও ড্রামস্টিক ৪০ টাকা। শামী কাবাব ১০ টাকা।
দোকানটির বয়স ১২ পেরিয়ে ১৩ - তে পড়েছে। মালিক মনসুর আহাম্মদ জানালেন তার দোকান শুরুর কথা - "আমি দোকান শুরু করেছি বারো বৎসর হলো। এই দোকানের পেছনে আমার ভাইয়ের মুদি দোকান আছে। ওখানে আগে কাজ করতাম, তারপর এই দোকান করি।"
মনসুর আহাম্মদের দোকানে তিনি ছাড়াও আরো তিনজন আছেন। এর ভেতর পলাশ নামে একটি ছেলে ভাজাভুজির কাজগুলো বেশি করে। তবে মনসুর আহাম্মদ অনেক সময় নিজেও থাকেন।
তিনি ছিলেন একজন হাবিলদারের পুত্র। তার ঢাকা জীবন পার করছে ৪৭ বছর। বয়স এখন ৫৫/৫৬ হবে বলে জানালেন।
কৌতুহল তখন ছেয়ে ফেলেছে মনকে - তাহলে উনি ঢাকা এলেন কীভাবে?
সদা হাস্যজ্বল মনসুর আহাম্মদ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে পড়লেন। "আমার জন্ম হয়েছিল নওগাঁয়৷ ঠিক কোথায় তা আজ আর মনে নাই৷ তবে চকদেবপুর বা এমন নাম হবে।"
জায়গাটির নাম চকদেবপাড়া কিনা জানতে চাইলে বললেন, "হতে পারে। ঠিক খেয়াল নাই। আমার বাবা ছিলেন পুলিশের হাবিলদার। পোস্টিং ছিলো রাজশাহীর গোদাগাড়ির পত্নীতলায়।”
“স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স চার বছর। তখন আমরা রাজশাহীতেই। আব্বা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। অন্যান্য পুলিশেরা তাকে জেলে আটকে রাখে। বলেছিল, আব্বাস খান (ওনার বাবার নাম) তুমি আপাতাত এখানে আটকা থাকো। পরেরটা দেখা যাবে।"
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ - ৭৫ সালে রাজশাহীতেই ছিলেন তারা সপরিবার। ১৯৭৫ - এ তার বাবার পোস্টিং হয় ঢাকায় মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে। পূর্বপুরুষের দিক থেকে তার বাবা ছিলেন বিহারের মানুষ। ঢাকা এসে জেনেভা ক্যাম্পেই তাদের বসবাস শুরু।
তিনি বললেন, “পড়াশুনা করেছিলাম কিছুদূর। এরপর ভাইয়েরা মিলে ব্যবসা শুরু করলাম৷ এখানে আগে অন্য দোকান ছিলো। ১২/১৩ বছর আগে ২০০৯ সালে ওই দোকানটা আমি কিনে নিলাম। আগে তো মুদি দোকান করতাম। তারপর এখানে কাবাব শুরু করলাম।”
কাবাবের দোকান হিসেবে এক দোকান পার হলেই ৫০/৫২ বছরের পুরনো শওকত চাপ ঘর। তাদের যে আইটেমগুলো ক্যাম্পে প্রচলিত, মনসুর সেগুলোই আনলেন। অন্যান্য দোকানের মতই দাম আনুপাতিকভাবে কমই রাখলেন।
এ প্রসঙ্গে বললেন," জিনিসের দাম বেড়েছে এটা সত্য। তবে আমি কাবাবের বা চাপের দাম বাড়াইনি৷ যারা খায় বেশিরভাগই এই ক্যাম্প বা আশেপাশের মানুষ। আর বিক্রি বাট্টা যা হয়, তাতে বেশ ভালো লাভ থাকে। প্রতিদিন ৩২-৩৫ কেজি মুরগি লাগে। দাম আমি একদিন ১৭০ টাকা কেজি কিনেছি, পরেরদিন আবার ১৬৫ পেয়েছি। তার পরদিন ১৬০ টাকা। এখন যেদিন ১৬০ এ পাচ্ছি সেদিন মনে করেন মুরগি বেশি করে (৩৫ কেজি) কিনে নিলাম। আবার যেদিন ১৭০, সেদিন আবার ৩০/৩২ কেজি কিনলাম৷ তাই কাবাবের দামে খুব একটা হেরফের হয়না।"
মনসুর আহাম্মদ বলছিলেন কাবাবের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ার কথা। একসময় এর পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিলো শুধু জেনেভা ক্যাম্পে। এখন ঢাকার নানা জায়গা থেকে মানুষজন আসে।
মনসুর আহাম্মদ সেই যে রাজশাহী ছেড়েছিলেন, আর ফেরা হয়নি সেখানে। বলছিলেন, "বিহারী বলে যে যুদ্ধের পর রাজশাহীতে কোনো সমস্যা হয়েছিল তা না। আব্বার পোস্টিং পরে ঢাকায় হলো। সব নতুন করে শুরু। উনি ১৯৮৯ এ মারা গেছেন। আমার আম্মা এখনো আছেন। আর ছেলেও এখন কাবাবের দোকান দিয়েছে। ওর ওখানে ক্ষিরিকাবাব, শিককাবাব আর আলু শিক পাবেন।"
দোকানটা চেনা খুব কঠিন নয়। ওনার কথাসূত্রে জানা গেলো, তার ছেলের নাম সফি আলম। সফি আলমের দোকান আরেকটু সামনেই। নাম নেই। উপরে কাগজে লেখা ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা), যা এই উপলক্ষে আয়োজিত মিলাদ উপলক্ষে লাগানো হয়েছিল৷ এই দোকানটিও স্থানীয়দের কাছে বেশ প্রিয়৷ শিক/ ক্ষিরির ওপর অল্প সরিষার তেল স্প্রে করায় আলাদা স্বাদ আসে।
মনসুর আহাম্মদ জানালেন দৈনিক ৭/৮ হাজার টাকার বেচা - বিক্রি হয়। লাভ থেকে দুই/আড়াই হাজার টাকা। কখনো কখনো তা ৩ হাজার ছোঁয়। আর এসবকিছু হয়েছে কোনরকম সাইনবোর্ড ছাড়াই৷ দোকানটি এতই জনপ্রিয় যে, একনামেই সবাই চেনেন।
নিজের ও ছেলের সাফল্যে বেশ সন্তুষ্ট মনসুর আহাম্মদ। পাশে থাকা রাসেল বিরিয়ানী হাউসের মালিকও প্রশংসা করলেন তার কাবাবগুলোর।
প্রতিদিন বিকাল ৫ টা থেকে রাত একটা - দেড়টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। রাত মোটামুটি বারোটার মত হয়ে এলে মনসুর আহাম্মদ ভেতরে বসেন। জায়গাটি ছোট। একসাথে ৪/৫ জন বসা যায়৷ মূলত আশেপাশের মানুষ কাবাব দাঁড়িয়েই খায় দোকানের সামনে। মনসুর আহাম্মদ সন্তুষ্টি নিয়ে দেখেন লোকদের ভিড় ও উপভোগ করেন তার কাবারের জনপ্রিয়তা। যার জন্য এমনকি কোনো সাইনবোর্ডও লাগেনা, তার নামটিই যথেষ্ট হয়ে যায়।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।
mahmudnewaz939@gmail.com
