বৃহত্তর খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষদের কাছে অতি পরিচিত একটি মশলা 'চুই।' এটি মূলত একটি উদ্ভিদ, যার রয়েছে নানাবিধ ওষধি গুণও। খুলনা-যশোর অঞ্চলের সব জেলায় মাংসে চুই ও রসুন দিয়ে রান্না করার চল আছে৷
বর্তমানে ফুড ভ্লগিং জনপ্রিয় হবার সুবাদে নানান অঞ্চলের খাবার নিয়ে আগ্রহ জেগেছে ঢাকার বাসিন্দাদেরও। সে সুবাদে ঢাকায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মিলছে চুইঝাল। গরু কিংবা খাসির মাংসের সঙ্গে চুই ও রসুন দিয়ে করা মাংসের ঘন ঝোলের ঝাঁঝালো স্বাদ নিতে নানা প্রান্তে থেকে এসব হোটেলে আসেন মানুষেরা।
এমনই একটি হোটেল পুরান ঢাকার 'চুই ঝাল।' সাইনবোর্ডে নামের ওপর লেখা 'খুলনার ঐতিহ্যবাহী।' হোটেলটির অবস্থান ৪৫, হোসেইনি দালান রোডে।
দোকানটি আকারে ছোট, তবে ছিমছাম। ভেতরে থাকা তিনটি টেবিলে বসতে পারবেন ১২ জনের মতো। আছে চুইঝালে রান্না করা গরু ও খাসির মাংস। চুইয়ের সাথে দেয়া হয় রসুনও। খেতে পারবেন ভাত অথবা পোলাও- যেকোনোটির সঙ্গেই।
চার রকমের সেট মেনু আছে দোকানে। পোলাও - এর সঙ্গে গরু অথবা খাসির মাংস দিয়ে দুরকম সেট মেনু। আবার, ভাতের সঙ্গে আর দু’রকম৷ তার সঙ্গে নিতে পারবেন ডাল, ভর্তা, মিষ্টি পান। গরুর এক পিস মাংস ১৫০ টাকা, খাসির মাংস ১৬০ টাকা। দুটোই আকারে বেশ বড়। এক/দেড় প্লেট ভাতের সঙ্গে খেতে পারবেন অনায়াসেই৷ সেট মেনু রয়েছে পোলাওয়ের সঙ্গে ২২০ টাকার (খাসি) ও ২১০ টাকার (গরু)। আর ভাতের সঙ্গে খাসির মাংস দিয়ে ১৯০ টাকা ও গরুর মাংস দিয়ে ১৮০ টাকা। তবে কেউ চাইলে সেট মেনু না নিয়ে ইচ্ছেমতো আলাদা আইটেম নিতে পারেন।
দোকানের ম্যানেজার জনাব মিঠুন সে সময় উপস্থিত ছিলেন না। কাউন্টারে বসা ছিলেন কর্মচারী জনাব সুমন ও সবাইকে পরিবেশন করছিলেন লিটন। কথা হয় তাদের সঙ্গে।
সুমন বললেন, " দোকানের বয়স বেশি দিন হয়নি৷ তিন মাসেরও কম। আমাদের মালিকসহ সবাই আমরা খুলনার।"
লিটন জানালেন, " দোকানের মালিক স্বাগত দাশ অঙ্কন। দাদা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথেও আছেন। উনিসহ আমরা সবাই খুলনার চুকনগরের। উনি আড়াই মাস আগে এখানে দোকানটা চালু করেন। ম্যানেজার এক জন, আমরা কর্মচারী দুই জন, বাবুর্চি একজন- এই মোট চারজন এখানে আছি। "
তিনি আরো বললেন, " আমাদের বাবুর্চি পিন্টু ভাই খুলনার আব্বাস হোটেলে কাজ করতেন। ওনার রান্নার হাত খুবই ভালো। অঙ্কন দা যখন এই হোটেল খুললেন, তখন উনি ঢাকা এসে এখানে যোগ দেন। "
গরুর মাংসের চুই (সিনার মাংস) ও ভাত, ছবি: লেখক
তাদের কথার সূত্রে জানা গেলো, তারা প্রতিসপ্তাহে খুলনা থেকে চুই আনেন। বড় কার্টনে আসে, ফ্রিজে রাখা থাকে৷ বড় একটি ডাল বের করেও দেখালেন লিটন। রান্নার সময় ছাল তুলে ফেলে চিকন চিকন করে কেটে মাংসে দেয়া হয় চুই৷
লিটন জানান, " আমাদের এখানে প্রতিদিন দুপুর ১২ টা রাত ১২ টা পর্যন্ত হোটেল খোলা থাকে৷ তবে কোনোদিন আগেই শেষ হয়ে গেলে আমরা আগেই বন্ধ করে ফেলি। যেমন- গত শুক্রবার রাত নয়টার ভেতরই সব খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতেও শুক্রবার অনেক ভিড় থাকে। অন্যান্যদিনও দুপুরে নামাজের পর আর রাত আটটা-নয়টার দিকে লোকজন বেশি আসে।"
চুইয়ের ভেতর গরুর মাংসের চুইয়ের চাহিদা খাসির চেয়ে বেশি বলে তারা জানালেন। এছাড়া, পোলাওয়ের চেয়ে ভাত বেশি চলে বলে জানান তারা।
লিটন বললেন, " আসলে মাংসে তো তেল থাকে। পোলাওটাও তেলের দিকেই চলে যায়। তাই দুইটা তেলের খাবার না নিয়ে মানুষ পোলাওটার চেয়ে ভাতই বেশি চায়। এ কারণে পোলাও রান্না কম করা হয়। "
ডাল ১০ টাকা, ভর্তা ১৫ টাকা ও বেগুন ভাজি প্রতি পিস ১৫ টাকা রাখেন তারা। সেট মেনুতে বেগুন ভাজা না থাকলেও কেউ চাইলে আলাদাভাবে দাম দিয়ে নিতে পারবেন।
ডাল মূলত মসুর ও মুগ মিশ্রিত করে তৈরি করা হয়। ভর্তা হিসেবে আলু ভর্তা দেয়া হয়। তবে মিষ্টি পান সেট মেনুর বাইরে আলাদা করে নেয়ার সুযোগ নেই বলেই জানান লিটন ও সুমন।
একসময় ভাতের দুটো অথবা পোলাওয়ের দুটো অথবা যেকোনো দুটো প্যাকেজ একত্র করে ফ্যামিলি প্যাকেজের প্রচলন ছিলো। তবে চাহিদা কম থাকায় তারা সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
এমনিতে দোকান থেকে হোম ডেলিভারি নেয়া গেলেও ফুডপান্ডা বা এমন কোনো অনলাইন মাধ্যমে হোম ডেলিভারি নেয়ার সুযোগ নেই।
হোটেলে প্রতিসপ্তাহে চুই আসে খুলনা থেকে, ছবি: লেখক
লিটন জানালেন, " এদিক থেকে ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা ভার্সিটি, বুয়েট কাছে। ছাত্র-ছাত্রীরাই বেশি খেতে আসে। স্থানীয় অন্যান্য লোকজনও আসে; তবে কাস্টমারদের ভেতর তরুণ বয়সী মানুষই বেশি।এ পর্যন্ত যারা খেয়েছেন বেশিরভাগই প্রশংসা করেছে রান্নার।"
গরুর মাংসের চুইয়ের স্বাদ নিয়ে মনে হলো রান্না ঠিকঠাক। তারা আগে সব কাস্টমারকেই মাংসের কড়াই এনে দেখান। পছন্দমত মাংস নেয়া যায় তা থেকে। সাথে পাবেন ২/৩ টি রসুন আর ৩/৪ টি চুইয়ের টুকরা৷ চুইয়ের ঝাঁঝালো স্বাদ ও ঘ্রাণ মাংসে মিশেছে বেশ ভালোভাবেই। সাথে বেগুনভাজা ও আলুভর্তা অনেকটা বাড়ির স্বাদই দেবে। মাংসের আকার সন্তোষজনক ও দেড় প্লেট ভাত এর সঙ্গে খেয়ে ফেলতে পারবেন অনায়াসেই।
লিটন বলছিলেন, "আমরা সবাই খুলনার ও বাবুর্চি ভাইও খুলনার। একারণে আমাদের রান্নায় চুইয়ের অরিজিনাল টেস্ট পাবেন।আমরা দেশি চুইটা ব্যবহার করি। এটা প্রাকৃতিক। চাষের যে মোটা চুই, সেটা ব্যবহার করা হয়না। ওতে আসল স্বাদটা আসেনা।''
সেটি অনেকাংশেই সত্য মনে হয়েছে তাদের রান্না করা মাংসের স্বাদে। তবে তেলের পরিমাণ আরেকটু কমলে হয়তো আরো ভালো হতো। তবে সবমিলিয়ে, 'চুই ঝাল' হোটেলের চুই সহযোগে রান্না করা মাংস ভোজনরসিকদের রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে বেশ ভালোভাবেই সক্ষম। তাই একদিন স্বাদ নিতেই পারেন তাদের রান্নার। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে চানখাঁরপুল মোড় নেমে হেঁটে/ জেলখানা রোড বলে রিকশা করে যেতে পারবেন। এছাড়া, শাহ মখদুম মাজার/ কেন্দ্রীয় কারাগার এর সামনে থেকে হাঁটতে শুরু করে বামদিকে যাওয়া রাস্তাটি ধরে একটু হাঁটলেই পেয়ে যাবেন। কিংবা চানখাঁরপুল মোড় থেকে রিকশা করা মাজার মোড়ের একটু আগে যেখানে রাস্তা দু ভাগ হয়েছে, সেখানে এসে ডানদিকে কিছুটা যেতে হবে।
দোকানটি অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়ায় অনেকেই চেনে না। তবে স্থানীয়দের মাঝে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে 'চুই ঝাল।' এটি আরো বাড়বে বলেই আশা করছেন দোকানের সাথে সংশ্লিষ্টরা। মান রক্ষার বিষয়েও তারা রয়েছেন সচেতন।
কোনো এক ছুটির দিনে তাই নিত্যদিনের স্বাদ বদলে নেয়া যেতে পারে পুরান ঢাকার এই চুইয়ের স্বাদ৷
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন।