প্রাচীন গ্রীক পুরাণে উল্লেখ আছে দুই মাথা ওয়ালা লেজ বিশিষ্ট এক প্রাণির কথা। তার নাম কাইমেরা। একটি মাথা ও ঘাড়ের দিকটা সিংহের মতো। আরেকটি মাথা ও লেজ সাপের মতো। আর পিঠের দিকটা ছাগলের মতো। ভারতীয় পুরাণে থাকা নৃসিংহ অবতারও খানিকটা এমন। নৃ অর্থ মানুষ। এখানে সিংহের সঙ্গে একই দেহে থাকে মানুষও। এরকম কয়েকটি প্রাণির অস্তিত্ব নিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রাণিকে বলা হয় কাইমেরা। আর গ্রীক পুরাণের সেই প্রাণি কাইমেরার নামেই নামকরণ হয়েছে কাইমেরিজমের।
কাইমেরিজম কী
সাধারণত মানুষের দেহে সুনির্দিষ্ট এক সেট ডিএনএ থাকে। বংশগতিক ধারা অনুযায়ী ডিএনএ উত্তরপুরুষ বা সন্তানদের ভেতর বাহিত হয়। তবে এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে শতাধিক ঘটনা আছে যেগুলোতে দেখা গেছে, একই ব্যক্তির শরীরে আছে দুরকম ডিএনএ। অর্থাৎ, নিজের শরীর ছাড়াও আরো একটি শরীরের চিহ্ন বয়ে চলছে এই প্রাণটি। এক শরীরে এমন একাধিক প্রাণের চিহ্ন বহন করার ব্যাপারটিই কাইমেরিজম। এক্ষেত্রে প্রাণিটিকে বলা হয় 'জেনেটিক কাইমেরা।'
প্রথম কাইমেরিক মানুষ
১৯৫৩ সালের কথা। মিসেস ম্যাক উত্তর ইংল্যান্ডের একটি ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিতে যান। তিনি রক্ত দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। স্ক্রিনিং টেস্টে ধরা পড়ে তার শরীরে বইছে দুই ধরনের রক্ত! তখন পর্যন্ত এমন ঘটেনি। মিসেস ম্যাকই পৃথিবীর ইতিহাসে শনাক্ত হওয়া প্রথম কাইমার।
মাতৃত্বের লড়াই
২০০২ সালে আমেরিকান নারী লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ড স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর দুই সন্তানের অভিভাবকত্ব লাভের জন্য আদালতে আবেদন করেন। কিন্তু ডিএনএ টেস্টে দুই সন্তানের কারো সাথেই তার ডিএনএ মেলেনি। এতে আদালত তাকে প্রতারক অভিযুক্ত করে। লিডিয়ার গর্ভে তখন তৃতীয় সন্তান। তার আইনজীবী আদালতে আবেদন করে আরো সময় নেন। তৃতীয় সন্তান জন্মের পর দেখা যায় তার সাথেও লিডিয়ার ডিএনএ মিলছে না। এরপর তার আইনজীবী ধারণা করেন লিডিয়া কাইমেরিক ও সেটিই সত্য প্রমাণিত হয়।
কেন এমন হয়?
কাইমেরিক প্রাণিদের দেহে দুইরকম ডিএনএ সেট থাকে। সাধারণত মানুষের শরীরে সকল কোষের ডিএনএ সেট একইরকম। কিন্তু কাইমেরিকদের ক্ষেত্রে লালায় একরকম, আবার জননকোষে আরেকরকম ডিএনএ সেট থাকে।
এর কারণ মূলত জীবিত ভ্রূণের ভেতর অন্যান্য মৃত ভ্রূণের ডিএনএ রয়ে যাওয়া। মায়ের শরীরে থাকা যমজ ভ্রূণের একটি অনেকসময় মরে যায়। বেঁচে থাকা ভ্রূণটি মৃত ভ্রূণকে নিজের ভেতর শুষে নেয়। ফলে তার শরীরে নিজের ও জন্ম না নেয়া ভাই/বোনের আরেক সেট ডিএনএ থাকে।
প্রকার
মূলত কাইমেরিজম যেভাবে বেশি ঘটে, তা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। একে বলা হয় 'টুইন কাইমেরিজম।'
এছাড়াও আরো কয়েকভাবে কাইমেরিজম ঘটতে পারে। যেমন- টেট্রাগ্যামেটিক। টেট্রা অর্থ চার। সাধারণত একটি শুক্রাণু দ্বারা একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট গঠন করে। তবে এক্ষেত্রে, দুটি শুক্রাণু দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে একত্রিত হয়ে যায়! এরপর একটিমাত্র ভ্রূণে পরিণত হয়। জন্মানো শিশুর দেহে ডিএনএ থাকে দুই সেট।
মাইক্রো কাইমেরিজমে মা ভ্রূণের অথবা ভ্রূণ মায়ের কিছু কোষ শুষে নেয়। এই কোষগুলো তাদের রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে শরীরের কোনো অঙ্গে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
দেহে দুরকম রং
হাইপারপিগমেন্টেশন ও হাইপোপিগমেন্টেশন - এ দুধরণের রংবিষয়ক প্রকাশ লক্ষ করা যায় কাইমেরিজমে।
হাইপার অর্থ বেশি, হাইপো অর্থ কম। হাইপারপিগমেন্টেশনে শরীরের ছোট কোনো জায়গা জুড়ে বা অর্ধেকের মত অংশে বাকি অংশের চেয়ে গাঢ় রং দেখা যায়। যেমন- গায়িকা ও গীতিকার টেইলর মুহল এর শরীরে এমন কাইমেরিজম লক্ষ্যণীয়। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত শরীরের এক পাশের খয়েরি ধরনের রংকে জন্মদাগ বলে জেনে এলেও পরে জানতে পারেন তিনি হাইপারমিগমেন্টেড কাইমেরিক ব্যক্তি।
আবার, এর বিপরীতটি ঘটলে, অর্থাৎ রং হালকা হলে তা হাইপোপিগমেন্টেশন।
তবে মানুষের শরীরের রং ছাড়াও দুই চোখের মণির রঙে ভিন্নতাও কাইমেরিক হওয়ার চিহ্ন। এমনটা অন্যান্য প্রাণি, যেমন- বিড়াল, কুকুরদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
মিসেস ম্যাক ও লিডিয়ার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল
মিসেস ম্যাকের ঘটনাটি নিয়ে গবেষণা করে ইংল্যান্ডের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের ব্লাড গ্রুপ ইউনিট। রবার্ট রেস ও রুথ স্যাঙ্গার এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মিসেস ম্যাকের জমজ ভাই ১৯২৩ সালে তিন বছর বয়সে মারা যায়। গর্ভে থাকাকালীন তাদের ভেতর পরস্পরবিরোধী 'হেমোপোয়েটিক স্টেম সেল ইনফিউশন' ঘটে। ফলে তার ভাই 'ইন্ট্রিন্সিক হেমোলাইটিক এনিমিয়া'-য় ভুগে মারা যায়। তবে বোনের দেহে এই ইনফিউশন অনেক কম ঘটায় অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন মিসেস ম্যাক।
লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ডের ঘটনায় পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্টে তার শরীরে থাকা একসেট ডিএনএ এর সাথে তার মা ও নানীর ডিএনএ মিলে যায়। এই স্যাম্পল ছিলো মূলত লালার ডিএনএ। যেটিকে 'সেট এ' ধরা যায়। কিন্তু লিডিয়ার সন্তানরা পেয়েছিল তার জননকোষে থাকা আরেকটি ডিএনএ সেট। এটিকে ধরা যায়, 'সেট বি।' মূলত, এই প্রতিবার লালাকে স্যাম্পল হিসেবে নেয়ায় সেট মিলছিলো না। পরে 'সেট বি'-র সাথে সন্তানদের ডিএনএ মিলে যাওয়ায় লিডিয়া পান সন্তানদের অভিভাবকত্ব। তার আইনজীবীর ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়- লিডিয়া একজন কাইমেরিক।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।