সংকটকালে বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ।
৪.৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।
৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ।
এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে আইএমএফ।
এছাড়া আইএমএফ এর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যার এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে।
২.২ শতাংশ সুদে নেওয়া এই ঋণ আসবে সাত কিস্তিতে। শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে।
ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশ রিজার্ভ বাড়াতে এমন অর্থের প্রত্যাশায় ছিল।
আইএমএফও তাদের বিবৃতিতে বলেছে, মহামারীর ধাক্কা সামলে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশ, কিন্তু ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাতে বৈদেশিক বাণিজ্যে চলতি হিসাব ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, টাকার মান কমে গেছে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে।
সাম্প্রতিক এই অর্থনৈতিক জটিলতাগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ একগুচ্ছ সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মনে করে, প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে, উত্পাদনশীলতা বাড়াতে এবং জলবায়ু সহনশীলতা তৈরি করতে হলে তাত্ক্ষণিক এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগুলোকেও আমলে নিতে হবে।”
বাংলাদেশকে ঋণ দিতে গত নভেম্বরে ঢাকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায় আইএমএফ। সেই ঋণচুক্তির শর্তসহ খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেন আইএমএফের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ।
এরপর বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ এর নির্বাহী বোর্ডের সভায় ওঠে এবং অনুমোদন পায়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঋণদাতা এ সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, “বিশেষ করে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়নেট মনসিও সায়েহ এবং মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দসহ যে দলটি এই ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তাদের প্রতি জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।”
আইএমএফের এই ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, “অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে আইএমএফ হয়তবা আমাদেরকে এই ঋণ দেবে না। তারা ভেবেছিল, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ দুর্বল তাই আইএমএফ এ ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকবে।
“এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হল যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে আছ এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।”
আইএমএফের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা সফরের সময় এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, আলোচনায় এ ঋণ কর্মসূচির মূল বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিয়েছেন তারা।
“রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, আরও দক্ষ একটি আর্থিক খাত গড়ে তোলার মত দীর্ঘদিনের চালেঞ্জগুলো আলোচনায় এসেছে। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণে উৎসাহ দিলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও সহনশীল করে তুলতে এবং দীর্ঘমেয়াদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা করবে।"
সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন আইএমএফের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ
“জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। জলবায়ু বিনিয়োগে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের পাশাপাশি আমদানি নির্ভর জলবায়ু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোও আইএমএফ এর আরএসএফ-এর (রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি) লক্ষ্য।
সব ঠিক থাকলে ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার।
এ ঋণের অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার হাতে নেবে, তার উদ্দেশ্য হবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এই ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।
কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে মান হারিয়ে চলছে টাকা, মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে।
রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানায় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে; জ্বালানি সংকটের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাই মাসে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফ এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অক্টোবরের শেষে ঢাকায় আসেন।
দুই সপ্তাহ সরকারে বিভিন্ন দপ্তর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর ঋণের বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতার কথা জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে।