Loading...
The Financial Express

সুষুপ্ত দুঃখে বোনা এক কাব্য ‘মির্জা গালিব’

| Updated: June 18, 2022 12:02:42


মির্জা গালিব।  ছবি: দা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস  মির্জা গালিব।  ছবি: দা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস 

বেদনার সাথে হাস্যরসকে মিলিয়ে দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই মানবজীবনকে যেন অনেকটা দূর থেকে বসে দেখেন মির্জা গালিব। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মুচকি হাসি, চোখে একইসাথে কৌতূহল আর ঔদাসীন্য খেলা করে। এমন দূর থেকে দেখতে পারেন বলেই অনেক দৃশ্য তার কাছে অন্য যে কারো চাইতে বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এতটা স্পষ্ট যে কারো কারো কাছে তা দুর্বোধ্যতার তকমা পায়। তারই সমসাময়িক কিছু লোক তাই তার দিকে ছোঁড়ে এমন তীর্যক মন্তব্যের তীর- ‘মীরের কবিতা বুঝলাম, মির্যার কাব্যও বুঝি - আপনার লেখা আপনিই বোঝেন, নয়তো খোদা বোঝেন।’   

তার এই তথাকথিত ‘মুশকিলপসন্দ’ স্বভাব ব্যক্তি আর কবি- জীবনের উভয় দিকেই তাকে রেখেছে সময়ের আগে সময়ের সমঝদার করে। তবে তার জন্য এই দুই জীবন বোধহয় খুব একটা আলাদা কিছু ছিলও না। ভারতের দূরদর্শন চ্যানেলে গালিবকে নিয়ে প্রচারিত, গুলজার পরিচালিত ধারাবাহিক অনুষ্ঠানটিতে নাসিরুদ্দীন শাহকে দেখা যায় তার চরিত্রে। ব্যক্তি গালিবের দুর্বোধ্য হবার বেদনাকে যেন সেখানে বইয়ের পাতা ভেদ করে সচিত্র, আরো বাস্তব হয়ে উঠতে দেখা যায়।   

বাংলাদেশে উর্দু সাহিত্যকে নতুন নিরীখে দেখছেন জাভেদ হুসেন। তার লেখা ও অনুবাদের বুননে মির্জা গালিব উঠে এসেছেন ‘মির্জা গালিবের সাথে আরও কয়েকজন’ বইটিতে। মির্জা গালিবের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মির্জা গালিব উপমহাদেশের এক যুগসন্ধিক্ষণের দর্পন। একটা বিশাল সভ্যতা ধ্বসে পড়ছে তখন। গালিব সে ধ্বসের আগে তার সকল অর্জন তার কবিতায়, চিঠিতে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের জীবনের সব অবমাননা, ক্লেশ আর বেদনা প্রবল পরিহাসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন:  

  

‘রাত-দিন গর্দিশ মেঁ হ্যায় সাত আসমাঁ  

হো রহেগা কুছ না কুছ ঘাবড়ায়ে কেয়া’।  

মানে,  

‘রাত-দিন আবর্তিত হচ্ছে সাত আসমান  

কিছু না কিছু তো হবেই, ঘাবড়ে কী লাভ।’   

জীবনকে এই বড় ক্যানভাসের প্রেক্ষাপটে দেখতে পারা একটা জরুরি ব্যাপার। নিতান্ত মোটা দাগের আত্মস্বার্থের ঘানিতে কলুর বলদ হয়ে ঘুরে বেড়ানো থেকে বের হয়ে আসা দরকার। আর সেই পথে মির্জা গালিব বড় সহায় হতে পারেন আমাদের জন্য।” 

এই বার্তারই আরেক পিঠ দেখতে পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী আহমেদ জালালের বক্তব্যে, “ক্ল্যাসিক্যাল উর্দু কবিতা বা শায়েরীর প্রাণ হলেন - মির্জা গালিব, মির তাকি মির, আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে গালিবকেই এগিয়ে রাখব। যেহেতু তিনি সবসময়ই তরুণদের জন্য প্রশান্তিদায়ক বলে পরিচিত হয়েছেন। এই যেমন তার বিখ্যাত কাপলেট- ‘মহব্বত মে নাহি হ্যায় ফারক জিনে আউর মারনে কা, উসি কো দেখ কার জিতে হ্যাঁয় জিস কাফির পে দাম নিকলা।’ তবে তিনি যোগ্যকবিকেও মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেননি। যেমন - মির তকী মিরের সম্মানে লিখেছেন- ‘রেখতে কে তুমহি উস্তাদ নেহি হো গালিব, ক্যাহতে হ্যায় আগলে জামানে ম্যায় কোই 'মির' ভি থা।’’ একবিংশ শতাব্দির হিংসা-প্রতিহিংসা-দ্বেষ - ঈর্ষাকে প্রেমের ভাষায় রূপান্তর করতে হলে গালিবকে অধ্যয়ন করা জরুরি।”  

প্রেমিক গালিব 

‘ইশক নে গালিব কো নিকম্মা কার দিয়া, ওয়ারনা হাম ভি আদমি থে কাম কে’ - প্রেম নিয়ে তার এই উক্তিটি বেশ জনপ্রিয়। প্রেমের অনলে পুড়ে যাওয়া লোকেদের ক্ষতের মলমও বটে।   

গালিবের প্রেম নিয়েও বয়ে যায় কত না গল্পের স্রোত। ঐতিহাসিক ভিত্তি না থাকলেও বহুভাবে বহুবার তার এক প্রেমিকার কথা ঘুরেফিরে আসে। উর্দু সাহিত্যের আরেক ক্ষণজন্মা - মান্টো, গালিবের মৃত্যুর বহু বছর পর তার সাথে যে কথোপকথনে মজেছিলেন, তার উল্লেখ মেলে রবিশঙ্কর বলের ‘দোজখনামা’ বইতে। সে মান্টোর জীবনের শেষ চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল গালিব ও তার প্রেমিকাটির গল্প নিয়ে। চৌদভি কি চাঁদনি। দূরদর্শনে প্রচারিত ধারাবাহিকটিতেও সেই নারী এসেছেন নওয়াবজান নামে।  

যদিওবা সত্যতার চেয়ে গল্পের গুঞ্জনে মানুষ বেশি মশগুল হয়, তবু গালিবের অনেক চিঠি ও কাব্যের সূত্র ধরে আঁচ করা যায়, প্রেমিকাটি অন্তত অভিজাত শ্রেণির কেউ ছিলেন না। হয়তো তাদের মধ্যকার সেই সামাজিক ফারাক তাদের প্রেমকে করেছিল আরো বেদনাকাতর, কাব্যের মতো মধুর। দাম্পত্যে গালিব কখনো সুখী হয়েছেন বলে জানা যায়নি। তাকে দেখা যায়নি দ্বিতীয় বিয়ে করতেও।  

চিরবিরহ বেছে নেয়া প্রেমের এ গল্পে একদিন বেরসিক মৃত্যু এসে ঘটায় চিরবিচ্ছেদ। শোকগাথায় গালিব শুধু জন্ম দিতে পেরেছিলেন আরো একটি গজল।  

২৭ টাকা মাহিনাতে ২০ জনের সংসার যিনি টানতে বাধ্য হতেন, তিনিও গালিব; আবার বাস্তবের কর্কশ ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে অন্য কেউ ভেবে নিয়ে যিনি পালাতে পারতেন - তিনিও গালিব। জমিনে পা রেখে হাঁটা ছাপোষা লোকটাও যেমন গালিব; শায়েরির পাখায় ভর করে আসমানে ওড়া লোকটাও তো গালিবই। খোদার আরশে রাখা প্রার্থনাবাক্যে স্বর্গকে তিনি তাই নির্দ্বিধায় মিলিয়ে ফেলতে চান নরকের সাথে, এ ধরাধামে তার হেঁটে বেড়ানোর জায়গা একটু কম পড়ছিল।  

ঠিক যেমন সমসাময়িক ইংরেজি টেনিসনের ‘লোটাস ইটার’ কবিতায় অডিসিউস যেমন পার্থিব জগতের আবরণ ছাড়িয়ে অচেনা পথে ভাসতে চেয়েছে। যে কারণে হয়তো গালিবের বহু বছর পর বাংলাভাষী কবি হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, ‘কে আছেন? দয়া করে আকাশকে একটু বলেন - সে সামান্য উপরে উঠুক, আমি দাঁড়াতে পারছি না’।  

অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন। 

anindetamonti3@gmail.com 

Share if you like

Filter By Topic