Loading...
The Financial Express

ভাইসাব সমাচার

| Updated: March 16, 2022 14:53:12


ভাইসাব সমাচার

‘ভাইয়েরা, ভাবিরা; কেমন আছেন আপনারা? মন আপনার, ভালো রাখার দায়িত্ব ভাইসাবের। এই প্রত্যয়কে বুকে ধারণ করে কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ভাইসাব।’

বিভিন্ন ভিডিওতে এই কথাগুলো বলতে শোনা যায় হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণকে। কথা বলেন নেত্রকোণা অঞ্চলের  ভাষায়। ফেসবুক ও ইউটিউবে তার পরিচিতি ‘ভাইসাব’ নামে।

একেকটা ভিডিওতে মজার ছলে তিনি তুলে আনেন সামাজিক নানা অসঙ্গতি। তার স্বভাবসুলভ হাস্যরসের সাথে ব্যাঙ্গোক্তি ও স্লেষবাক্যের মিশেলে সব বয়সের-শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেই হয়ে উঠেছেন খুব জনপ্রিয়। একেকটা ভিডিও প্রচারের সাথে সাথেই লক্ষাধিক ভিউ ও হাজারেরও বেশি শেয়ার তার জন্য খুব সাধারণ ঘটনা।

ভাইসাব নামের এই তরুণ আসলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থী। তার প্রকৃত নাম সামিউল হক ভূঁইয়া। বাড়ি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায়।

নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থী হবার সুবাদে অভিনয়, ভয়েস ওভারের মত ব্যাপারগুলো তার কাছে ছিলো বেশ পরিচিত। পারিবারিক ব্যবসায় সময় দেয়ার পাশাপাশি তিনি মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়ও করে থাকেন।

করোনার সময়টায় বাড়িতেই ছিলেন একটানা অনেকদিন। তখন মাথায় আসে আশেপাশের ব্যাপারগুলো নিয়ে ভিডিও বানানোর কথা । ২০২১ সালের জানুয়ারির একেবারে শুরুতে আসে তার প্রথম ভিডিও। সেটা তিনি নেত্রকোণায় তার গ্রামেই করেছিলেন। 

তবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত পেয়ে যান বিসিএস বিষয়ক একটি ভিডিওর মাধ্যমে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াদের বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন-পুলিশে আসা নিয়ে প্রচুর ট্রল হচ্ছিল তখন।

সময়টা গত বছরের মার্চ-এপ্রিল। সে সময় ব্যাঙ্গোক্তির আদলে এর কারণ তুলে ধরেন তিনি। বিভিন্ন ক্যাডারে থাকা বৈষম্য, দেশীয় চাকরির বাজারের অব্যবস্থাপনার মতো কঠিন ব্যাপারগুলোকে হাস্যরসের মাধ্যমে একেবারে পানির মতো সহজ করে তুলে ধরেন দর্শক-শ্রোতাদের সামনে।

এরপর ক্রমান্বয়ে আরো বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। যার ভেতর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সড়ক পথের অব্যবস্থাপনাও আছে।

একদিন যেমন গ্রামের ভেতরের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় রিকশা দিয়ে যেতে যেতে তিনি বলছিলেন এসব 'উন্নত' রাস্তার বিশেষ সুবিধার কথা। যেমন -

“এইসব রাস্তা ভাংগা থাকায় কারো রিলেশন-বিয়ে-সংসার ভাঙবোনা। কিন্তু যদি ধরেন কন্ট্রাক্টর ঠিকমত রাস্তা বানায়, ইঞ্জিনিয়ার আলাদা টাকা না নেয়; তাইলে কি তাদের সংসার চলবে?...... আবার এই রাস্তার সুবিধা হইলো এটা দিয়ে যাইতে আপনার যাদের ডেলিভারি (সন্তান জন্মদান) হওয়ার কথা, সেটা সিজার বা অপারেশন ছাড়াই হয়ে যাবে।.... আবার মনে করেন রাস্তা ভালো থাকলে যারা বিদ্যাশ গেছে, হেরা ফিরে আইসা তো নিজের বাড়িই চিনবোনা, রাস্তা এমন ভাঙা-চোরা থাকলে বাড়ি চিনতেও সুবিধা।”

এভাবে হাস্যরসের মাধ্যমে মাধ্যমে সমস্যাগুলোর মূল জায়গায় আঘাত হানেন তিনি। তার কথাবলার ধরন দর্শক-শ্রোতাকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সংলাপগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। সাভারের রাস্তা নিয়ে তার করা একটি ভিডিও ভাইরাল হবার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম নিউজ হিসেবে সেখানকার রাস্তাগুলোর অবস্থা তুলে ধরে ও পরবর্তীতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়।

সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সরেজমিনে বাজার ঘুরে সেখান থেকে কথা বলেন ভাইসাব। তিনি বলেছিলেন, “এই যে জিনিসের দাম যে এত বাড়ছে, এটাকে আসলে নেগেটিভলি নেয়ার সুযোগ নাই। পত্রিকায় বলছে পঞ্চাশ হাজার টাকাতেও মাস চলেনা। দাম এত বাড়লে যাদের ইনকাম এরচেয়ে কম, তারা আর থাকবেনা। ডাইনোসরের মত ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তখন আর দ্যাশে কোন গরিব পাবেন না, এভাবে দ্যাশ উন্নত হয়ে যাবে।”

এখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা কী অসাধারণ সাবলীলতার সাথে তিনি তুলে ধরেছেন তা লক্ষণীয়। এভাবে হাস্যরসের মোড়কে মানুষকে শুনিয়েছেন অভাবী মানুষের কান্নার গল্প।

আবার সাম্প্রতিক আরেকটি ভিডিওটি তিনি কথা বলেছেন দৌড় নিয়ে। বাঙ্গালির যেকোন কিছুর পেছনে হুজুগের দৌড় নিয়ে শুরু হওয়া আলাপ শেষমেশ এসে মিলেছে টিসিবির লাইনে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিত্যপণ্য সংগ্রহের জন্য মানুষের বিশাল লাইন পড়ছে। ভাইসাব তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় বলছেন, “এভাবে লাইন করলে, দৌড় -দৌড় চললে অলিম্পিকের সোনা, রুপা, ব্রোঞ্জ যা আছে সব আমরা পাবো।” এভাবে মজার ছলে একটি বিষয় শুরু করে সেখান থেকে তুলে ধরেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের অসহায়ত্বের চিত্র।

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভিডিও করেছেন 'মাতৃভাষা' নিয়ে। হাসির ছলে মজার কথায় বিদ্ধ করেছেন ভাষাকেন্দ্রিক মৌলবাদকে। যেমন, নেত্রকোণার মানুষ হিসেবে তিনি বলেন সেখানকার ভাষা, তেমনি অন্য অঞ্চলের ভাষার স্বকীয়তা, আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে ঠাট্টা, পাহাড় বা সমতলের আদিবাসীদের মাতৃভাষার অধিকার প্রসঙ্গ মূর্ত হয়ে উঠেছে তার কথায়।

গত নারী দিবসে নারী নিয়েও বলেছেন কথা। নিজের পরিবার, মামা-মামিদের উদাহরণ দিয়ে মজার ছলে তুলে ধরেছেন সমাজ কীভাবে সবকিছুর জন্য নারীকে দোষারোপ বা ভিক্টিম ব্লেইম করে। পুরুষ ভালো কিছু করলেও কৃতিত্ব পায় পুরুষ, আবার পরিবারের খোঁজ না নিলে, কোথাও ব্যর্থ হলে দোষ তখন নারীর।

এভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুব সহজ কথায় মজায় মজায় কঠিন সত্য বলছেন ভাইসাব তথা সামিউল। কিন্তু এত কিছু থাকতে নাম হিসেবে ভাইসাব বেছে নেয়ার কারণ কী? এর উত্তরে তিনি জানালেন, “আসলে ভাইসাব নামটা কমন। সবাই সহজে বোঝে। কাউকে ভাইসাব ডাকা মানে তাকে নিজের কাছের মানুষ মনে করা যায়। আর আমি সাধারণ মানুষের কথা তাদের ভাষাতেই তুলে ধরতে চাই।”

তিনি যোগ করেন, “আমার ভিডিও বা নিজেকে নিয়ে বিশেষ কোন বক্তব্য নাই। আমি যে ভিডিওগুলো করছি, এখানে আশেপাশে দেখা ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার কথা  তুলে ধরছি। আর নেত্রকোণার ভাষায় বলি, যাতে মানুষ সহজে বোঝে আমার কথা। কঠিন কোন আলোচনা কিংবা একেবারে সরাসরি কোন বিষয়ে কথা বলা সমস্যার কারণ হতে পারে; তাই মজার ছলে, হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমেই বলি।”

তবে নিজেকে সেলিব্রেটি বা এমন কিছু বলতে চাননা তিনি। মঞ্চনাটকে কাজ করছেন, শিল্পের সাথে থাকতে চান। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান, মানুষের জীবন দেখতে ও প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে পছন্দ করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের জলপলকের গান নাটকে নিজ বিভাগের হয়ে একাধিকবার অভিনয় করেছেন। ভাইসাব পরিচয়ে তিনি এখন গণমানুষের কাছে একনামে পরিচিত। রাস্তায় বের হলে অনেকে চিনে ফেলে, সালাম দেয়। তিনি এতে আনন্দ পান, তবে জনপ্রিয়তার কারণে ব্যক্তিগত জীবন হারাতে চাননা। গণমাধ্যমের মুখোমুখিও হতে চান না খুব একটা।

সামিউল মনে করেন, শিল্পীদের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। তার ভিডিওগুলোর মাধ্যমে তিনি গণমানুষের ভাষাতেই বলতে চান মানুষের কথা। পাশাপাশি হাসিও ফোটান তাদের মুখে।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

mahmudnewaz939@gmail.com

 

Share if you like

Filter By Topic