বাবা পদ্য লেখেন। শাওন চুপটি করে দেখে। মনে মনে ভাবে, আমিও লিখব। আমিও হবো কবি। সবাই ডাক দিয়ে বলবে: ও কবি যাচ্ছো কই, এক কাপ চা খেয়ে যাও। জন্মকালে বাবা-মা আদর করে নাম শাওন রাখলেও, নিজস্ব দুনিয়ায় শাওন পাল্টে ফেলে নাম। রাখেন, ফকির লাল। বন্ধু আঙুরের দেয়া লাল আর নিজের ভাবনার জোয়ারে ভেসে আসা বোধ থেকে যোগ করেন ফকির। একদম শূন্য, দুনিয়াতে যার কিচ্ছুটি নাই।
ছোটকালে কবি হবার তীব্রতা থেকে ফকির সাহেব কবিতা লেখতে লেখতে নিজের আরেক পরিচয়ের সন্ধান পান। হিপহপ গান শুনতে শুনতে ভাবেন: আমার লেখায় পরিয়ে দিব সুর, এবং আমিই হবো বাংলা র্যাপের শুরু।
শুরুর গল্প
সিলেটে স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্লাসের পরপর 'কনকচাঁপা খেলাঘর' নামে সাংস্কৃতিক সংঘটনে আসা যাওয়া ছিল ফকিরের। ওখানে খেলতেন দাবা, তবলার বুক চাপড়ে তালের সাহস জমা করতেন হাতে হাতে। কখনো কখনো নজরুলে রাখতেন গলা। বাবার পদ্য লেখা থেকে সঞ্চয় করতেন সাহস। নিজেও কিছু একটা লিখতেন। বাবার বাহবা পেতেন। খুশি হতেন। এই ছিলো ছোটবেলার প্রেরণা।
এ প্রসঙ্গে ফকির লাল আরও যোগ করেন “ বাবার উৎসাহ এবং কোনোকিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং যার যার গুণাবলি যে যে খুঁজে নিবে এমন দুর্দান্ত দর্শনই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, যার ফলে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছি।”
ফকির লালের পরবর্তী গল্প লেখার দায়িত্ব পড়ে আমেরিকার কাঁধে। কারণ তখন তিনি পরিবারসহ পাড়ি জমান প্রবাসে।
নতুন জীবনের প্রাপ্তি ও বিসর্জন
নব্বই দশকে নিউইয়র্কে বাঙালির আনাগোনা ছিল কম। ছোট্ট শাওন ক্লাসে হন্নে হয়ে খুঁজতেন একজন বাঙালি বন্ধু।
হঠাৎ একদিন খেয়াল করেন, একটি ছেলে যে কিনা দেখতে ইংরেজ ধরনের হলেও তার সাথে মেশার খুব আগ্রহ নিয়ে কাছে আসে। কিন্তু ওদের আলাপের খাতা খুলে না। শাওনের দুঃখ কমে না। অবশেষে কথা হলো। বন্ধুত্ব হলো। জানা হলো, দুইজনই দেশি ভাই। বন্ধু আঙুরকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত শাওন। ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে লেখা পদ্য দেখে আঙুর পিঠ চাপড়ে শুভেচ্ছা জানায় তাকে।
ফকির লাল বলেন “যা লিখতাম তা নতুন ধরনের কিছু হওয়ায় অনেক বন্ধুই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত, আঙুর তখন প্রতিবাদের সুরে বলত, ‘সাবধান, নিজে যা করও না তা অন্য কেউ করলে— হয় উৎসাহ দাও নয়তো চুপ থাকো।’ এত অল্প বয়সে পোক্ত মানসিকতার কথা আমাকে ব্যাপক সাহস জুগিয়েছে।”
বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে। নতুন বন্ধু বাড়ে। কথা বাড়ে। একদিন আড্ডায় ফকির লাল, বাংলায় র্যাপ গান বা হিপহপ করার আগ্রহ জানায় বন্ধুদের। কথা শুনে অনেকেই হাসে। ইংরেজ বন্ধু জানায়, বাংলা ভাষা হিপহপ উপযোগী নয়। বাঙালি বন্ধুদের ভাষ্য, হিপহপ গান দেশের মানুষ কখনোই ভালোভাবে নেবে না। কিন্তু প্রিয় বন্ধু আঙুর জোড় গলায় জানায়, অবশ্যই শুনবে, সবাই শুনবে।
প্রিয় বন্ধুর অনুপ্রেরণাই তার শেষ সম্বল ছিল। এরপর বহুদিন কেটে গেলো। লেখার খাতায় লেখা বাড়ে৷ পরিকল্পনা বাড়ে। টুকটাক প্রস্তুতিও চলে হিপহপের। কিন্তু এরপর আসে নতুন এক গল্প। সময়টা ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখ, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস।
বন্ধুর সাথে চুক্তি হয় গোটা শহর ঘুরে দেখার। আঙুর রাস্তায় বেড়িয়ে কল করে শাওনকে। শাওন অনুমতি নিতে যায় মায়ের। মা বাধ সাধেন। সদ্য বিয়ে হওয়া বোনের পরিবারকে বাসায় দেওয়া হয়েছে দাওয়াত। বাবা নেই বাসায় কিন্তু সদাইপাতি দরকার। দায়িত্ব পড়ে লালের কাঁধে।
মায়ের সাথে কথার যুদ্ধে না পেরে বন্ধুর কাছে ফোনকলে দুঃখ প্রকাশ করে শাওন। ফোন রাখার কয়েকঘন্টা পর খবর আসে, রাস্তায় ফেলে রাখা ডিনামাইট বিস্ফোরণে আঙুর পালিয়ে গেছে আকাশে। ফকির লালের হৃদস্পন্দন তখন বন্ধ হবার জোগাড়। নিঃশব্দের জয়গান তার বাসায়। লাশ দেখার সাহস পাননি আর। মা বোঝানোর চেষ্টা সব মানুষ মরে যায় একদিন। এদিকে বাবা বলেন ভিন্ন কথা।
যার চলে যায় সেই বুঝে হায় বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা!
প্রথম অ্যালবাম ও অ্যালবামের নামকরণ প্রসঙ্গ
প্রিয় বন্ধু চলে যাবার পর শোকে কাতর ফকির লাল থেমে যাননি। প্রয়াস রেখেছেন জারি। ২০০০ সালে প্রকাশ করেছেন প্রথম অ্যালবাম: একলাই একশো। পরবর্তীতে কালাসাদক এক্সপ্রেস নামক আরেকটি অ্যালবামে আঙুরের গল্পে বেধেছেন একটি গান (আঙুর)। যে গান তুমুল জনপ্রিয় হয় শ্রোতা মহলে। প্রশ্ন ছিল, একলাই একশো নামকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে, উত্তর ছিল: “হিপহপ গান একা গাওয়ার সাহস করা কঠিন। লম্বা কথার গানে চলে দমের খেলা, তালের খেলা, আরও কত কী। কিন্তু, কাউকে পাশে পাচ্ছিলাম না। তখন ভাবলাম, যা করার একাই করব, হিপহপ আমার করতেই হবে। একাই গাইলাম সবকটা গান।”
দাম্ভিকতা নয়, বরং কাউকে পাশে না পেলে একাই পথ চলতে হয় এমন একটি প্রেরণা সবাইকে দিতেই এমন নামকরণ।
গান লেখা, সফলতা ও আক্ষেপ
চট করে এক বসায় গান লেখতে পারেন না ফকির লাল। প্রথমে বাছাই করেন বিষয়বস্তু। তারপর তোড়জোড় চলে গবেষণায়। যাচাই-বাছাই করতে সাহায্য নেন বিভিন্ন বইয়ের কিংবা একাত্তর দেখা বাবা চাচার। কখনো কখনো মাস কেটে যায়, তবুও একটি শব্দ জোর করে বসিয়ে দেন না লেখায়। যা করব যত্ন করে করব, সত্যি কিছু করব, এমন প্রতিপাদ্য বুকে নিয়েই গান লেখেন। সফলতা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তার। দিনশেষে ভেতর থেকে তৃপ্ত হওয়াই বড় কথা। এমনটাই বিশ্বাস করেন তিনি।
আক্ষেপের জায়গা থেকে তিনি ভাবেন, হিপহপ গান; গানের এমন একটি ফরম্যাট, যেখানে অনেক কিছুই তুলে ধরা যায়। যা হয়তো অন্য ফরম্যাটে সম্ভব নয়। কিন্তু দেশে এখনো সেভাবে সমাদৃত হয় না হিপহপ গানের শিল্পীরা। তাদের ডাকা হয়না বড় কোনো আয়োজনে। অথচ আন্তর্জাতিক হিসাবে হিপহপ এখন অনেক উঁচুতে।
বাংলা র্যাপকে দু-হাত উজাড় করে দেওয়া ফকির লাল গানে গানে বুকের কথা বলুক। বলুক, আর্তনাদের কথা, ভাতের কথা, ক্ষুধার কথা কিংবা থেমে না গিয়ে তুমুল বেগে ছুটতে চলা সাহসের কথা।
সঞ্জয় দত্ত ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
ই-মেইল: sanjoydatta0001@gmail.com
