Loading...
The Financial Express

কুয়াকাটার পথে ‘কাঁটা’ ৩ সেতুতে ‘বাড়তি টোল’

| Updated: February 05, 2023 18:18:42


পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কের তিন সেতুতে টোল আদায়ের রশিদ। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কের তিন সেতুতে টোল আদায়ের রশিদ।

‘সাগরকন্যা’ পটুয়াখালীর কুয়াকাটাগামী পর্যটকবাহী ও পিকনিকের বাস থেকে তিনটি সেতুতে অতিরিক্ত টোল আদায় হচ্ছে, যার কারণে এ অঞ্চলের পর্যটন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। 

পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কের আন্দারমানিক নদীর ওপর শেখ কামাল সেতু, হাজিপুর সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল সেতু এবং শিববাড়িয়া নদীর ওপর শেখ রাসেল সেতু থেকে বাড়তি টোল আদায়ে অভিযোগ করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

তারা বলছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত টোলে তিন-চারগুণ বেশি আদায় করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে হয়রানি এবং খারাপ ব্যবহার করছেন ইজারাদারের কর্মচারীরা। অনেক ক্ষেত্রে এরকম পরিস্থিতিতে পর্যটকরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। 

তবে তিনটি সেতুর ইজারাদার দাবি করেছেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই। তারা এর খোঁজ নেবেন। 

পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। কলাপাড়া উপজেলা সদর থেকে কুয়াকাটার ২১ কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি নদীর ওপর এই তিনটি সেতু রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন শেখ জামাল সেতুতে টোল আদায় করে রফিক এন্টারপ্রাইজ, শেখ রাসেল সেতুতে মেসার্স খান ট্রেডার্স এবং শেখ কামাল সেতুতে মেসার্স নাজমুস সায়াদাত ট্রেডার্স।

সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর তুলনায় শীত মৌসুমের বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার গড়ে শতাধিক পিকনিকের রিজার্ভ বাস এবং পর্যটকবাহী বাস আসা-যাওয়া করে বলে জানান কুয়াকাটার ব্যবসায়ীরা। এই তিন দিন কুয়াটার পর্যটন অন্য দিনগুলোর তুলনায় বেশি চাঙ্গা থাকে।  

পরিবহন শ্রমিকরা জানান, অনেক সময় দেখা যায়, টুরিস্ট এজেন্সিগুলো তাদের পর্যটকদের রিজার্ভ বাসে করে নিয়ে আসে। এতে পর্যটকদের ভোগান্তি কম হয়, ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দজনক হয়। আবার কোনো অঞ্চল থেকে যখন একসঙ্গে অনেকে আসেন, তারাও বাস রিজার্ভ করে আসেন।

মূলত এসব বাস থেকেই অতিরিক্ত টোল আদায় করা হয়। কারণ, এতে পরিবহন শ্রমিক বা পর্যটকদের কিছু করার থাকে না। যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এবং ঝামেলা এড়াতে তারা অনেকটা চাপে পড়ে বা জিম্মি হয়ে সরকার নির্ধারিত টোলের চেয়ে বেশি টাকা দিতে বাধ্য হন।  

খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে ২০ জানুয়ারি রিজার্ভ বাস নিয়ে কুয়াকাটায় গিয়েছিলেন সুব্রত পরিবহনের চালক মো. শাহিন। তিনি মিনিবাস চালান। ভোর রাতে তিনি কুয়াকাটায় পৌঁছান। তিনটি সেতুতেই তাকে অতিরিক্ত টোল দিতে হয়েছে এবং টোল আদায়ে জড়িতদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়াতে হয়েছে।   

মিনিবাসের এই চালক বলেন, হাজিপুর শেখ জামাল সেতু এবং মহিপুর শেখ রাসেল সেতুর নির্ধারিত টোল ৫০ টাকা; কিন্তু রাখছে ১৮০ টাকা। আর শেখ কামাল সেতুর নির্ধারিত ১০০ টাকার টোল দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা।

“এত বেশি টোল কেন- জানতে চাইলে ইজারাদাররা বলে, এইটাই টোল। না হলে তুমি ব্রিজ পারাইয়া এপাড়ে আইছ কেন? ব্রিজ পারাইয়া ব্যাকে যাও। আর গালাগালিজ তো করছেই।”

চালক আরও বলেন, “তারা (ইজাদাররা) যেটা চাইবে সেটাই তো দেওয়া লাগবে। দূর-দূরান্ত দিয়া আসছি। যদি আমার গাড়িটা আটকাইয়া দেয়, তাইলে পার্টিরা তো বুঝবে না। তাই বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু টোল তো এইটা না। কায়দা করে বেশতি নিচ্ছে।”

“আমরা ভাড়া-টোলটা হিসাব করে মহাজনের কাছ থেকে গাড়ি আনি। টোল যদি বেশি দিতে হয়, আমরা দিনমজুরি করি, সে হিসাব করলে তো আমাদেরও বেতন থাকে না। আমাদের পকেট থেকে টোল দিতে হয়”, আক্ষেপ করে বলেন শাহিন।

অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ করেছেন চাঁদপুরের তিশা পরিবহনের চালক মো. জসীম উদ্দিনও। তিনি সবশেষ কুয়াকাটায় গিয়েছেন ২০ জানুয়ারি।

পদ্মা সেতু হওয়ার পর মানুষের কুয়াকাটার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বলে জানান চেয়ার কোচের এই চালক। পদ্মা সেতু দেখার সঙ্গে কুয়াকাটা ভ্রমণ- এটা টানছে পর্যটকদের। এবার শীত মৌসুমে জসীম চাঁদপুর থেকে কুয়াকাটায় অন্তত ১০ বার রিজার্ভ গেছেন।   

অতিরিক্ত টোল আদায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু এবং তার পরেও টোল দিছি। সব ঠিক নিছে। কিন্তু এই তিনটা সেতুতে অতিরিক্ত টোল দেওয়া লাগছে।”

তার ভাষ্য, শেখ কামাল সেতুতে চেয়ার কোচে ১৮০ টাকা নিধারিত টোল, নিচ্ছে ২৫০ টাকা। শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতুতে ১০০ টাকার জায়গায় নিচ্ছে ১৮০ টাকা।

“আবার অতিরিক্ত টাকার রশিদও দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলে বলে, আসলে আসেন নাইলে ঘুরাইয়া চইলা যান। আপনাদের আসা লাগবে না। এইটা তো বাড়াবাড়ি।”

তিশা পরিবহনের চালক জসীম বলেন, “দেশের সব প্রান্তেই বাস নিয়ে যাই। কোথাও সরকার নির্ধারিত টোলের অতিরিক্ত আদায় করতে দেখিনি। এখানে টোলপ্লাজার পাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাঁড়িয়ে থাকে। তারা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়।”

তিশা পরিবহনের যাত্রী ও পর্যটক সোহাগ রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কুয়াকাটা যাওয়ার পথে রাত সাড়ে ৩টার দিকে একটি সেতুতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়।

“এগিয়ে শুনতে পাই, অতিরিক্ত টোল চাওয়ায় বাসের চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে ইজাদারের লোকজনের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। টোল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, পিকনিক পার্টির বাসে এই হারেই টোল দিতে হবে। না হলে বাস ঘুরিয়ে গন্তব্যে চলে যাও, কেন উঠেছ ব্রিজে।”

কয়েকজন চালক ও সুপারভাইজার সেতুতে টোল দেওয়ার কয়েকটি রশিদ দেখান। তাতে দেখা যায়, ২০ জানুয়ারি শেখ কামাল সেতুর রশিদে একটি বড় বাসের (চেয়ার কোচ) টোল ১৮০ টাকার জায়গায় রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। ২১ জানুয়ারি একই বাস গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময়ও রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা।

একইভাবে শেখ জামাল সেতুতে ৯০ টাকার জায়গায় রাখা হয়েছে ১৮০ টাকা। গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময় আবারও ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। শেখ রাসেল সেতুতে ৯০ টাকার জায়গায় ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে।

স্থানীয় পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বললেও অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি সত্যতা পাওয়া যায়। তারা জানান, টোল আদায়ের তালিকা সেতুগুলোতে টানানো থাকে। সেখানে সরকার নির্ধারিত টাকাই লেখা থাকে। মাঝে মাঝে আবার খুলেও ফেলে।

একজন চালক বলেন, যারা লাইনে (ঢাকা-পটুয়াখালী-কুয়াকাটায় পথে চলাচলকারী পরিবহন) বাস চালায় তাদের কাছ থেকে ইজারাদারের লোকজন এত বেশি টোল নেয় না। হয়ত ১৮০ টাকা টোল, ২০০ টাকা নেয়। কিন্তু রশিদ ১৮০ টাকার দেয়।

বাড়তি টোল আদায় করা হয় যারা দূর-দূরান্ত থেকে আসে তাদের কাছ থেকে। তারা যেহেতু স্থানীয় না, এখানে তাদের পরিচিত কেউ নেই। অনেকেই গভীর রাতে সেতুতে আসে। এসব বাস দেখলেই ইজারাদারের কর্মচারীরা বুঝতে পারে। তাদের কাছ থেকেই বেশি টোল আদায় হয়। ফলে কিছু করার থাকে না বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা।  

কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যসচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি তার জানা ছিল না। নির্ধারিত টোল আদায়ের বাইরে যদি কোনো ইজারাদার অতিরিক্ত টোল আদায় করে থাকেন তবে তা খতিয়ে দেখে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম আতিক উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টোলের ইজারাদাররা সরকারি নিয়ম-কানুন মেনেই স্বাক্ষর করে ইজারা নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক টোলপ্লাজায় নির্ধারিত মূল্যতালিকার বোর্ড টাঙ্গানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

এর যদি কোনো ব্যতয় হয় বা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে তাহলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি ইজারা বাতিল পর্যন্ত করা হবে বলেও জানান প্রকৌশলী।

নির্বাহী প্রকৌশলী তিনটি সেতুর টোল আদায়ের মূল্যতালিকাও প্রিন্ট করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেন। সেখানে দেখা যায়, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতুতে কন্টেনারবাহী ট্রেইলারের টোল ২৫০ টাকা আর শেখ কামাল সেতুতে এর টোল ৫০০ টাকা।

বড় বাসের ক্ষেত্রে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতুতে টোল ৯০ টাকা এবং শেখ কামাল সেতুতে ১৮০ টাকা। টোল অনুযায়ী, রশিদ লাল, সবুজ ও হলুদ- এই তিন রংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনস অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি মো. ইমতিয়াজ তুষার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সপ্তাহের সরকারি ছুটির দিনগুলোতে শতাধিক পিকনিকের বাস আসে কুয়াকাটায়। কোনো কোনো শুক্রবার তারও বেশি আসে। সেতুর টোল বেশি আদায় হলে সেটা প্রথমত পর্যটকদের হয়রানি করা। দ্বিতীয়ত, কুয়াকাটার প্রতি পর্যটকদের বিরূপ ধারণা তৈরি হবে।

তিনি বলেন, সরকারি যে ভাড়াটা নির্ধারিত আছে সেটা নিতে হবে। পর্যটকদের প্রতি খারাপ আচরণ করলে পরবর্তী সময়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রশাসনিক অথবা যে কাঠামোই হোক এটা বন্ধ করা উচিৎ।

অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ রাসেল সেতুর ইজারাদার মেসার্স খান ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী আবুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই।

তিনি বলেন, “তবে আমার লোকজনকে বলে দিয়েছি। কারো কাছ থেকে একটি টাকাও বাড়তি নেবে না। আপনি বলছেন, আমি বিষয়টি দেখতেছি। আমি এখন ঢাকায়, এসে আপনার সঙ্গে কথা বলব।”

শেখ জামাল সেতুর ইজারাদার মেসার্স রফিক এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. জুয়েল হাসান অভিযোগ শুনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।”

পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা মোটেই সত্য নয়। আপনাকে যারাই বলেছে, সেটা মিথ্যা বলেছে। কারণ আমার লোকজনকে আমি বলে দিয়েছি, কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করবা না।

“আমি বুধবার পটুয়াখালীতে আসতেছি, আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হবে, চা খাব।”

শেখ কামাল সেতুর ইজারাদার নাজমুস সায়াদাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো টোলে অনেক দিন ধরে যাই না। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি বিষয়টা কী।”

কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পর্যটকবাহী বাসে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে আমাকে কেউ জানায়নি। এটা আমার আওতার বাইরে। তবে পর্যটকরা আমাদের মেহমান। টোলের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। যদি এর বাইরে কোনো ইজারাদার বা তার লোকজন বেশি ভাড়া আদায় করে তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”

Share if you like

Filter By Topic