ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে,
সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে
আলতা যেদিন পরেছিলে?
--আলতা স্মৃতি, কাজী নজরুল ইসলাম
লাল লাল তরল ভরা এক শিশি আলতা। সেই রূপকথার রাজকন্যার আমল হতে আজও রয়ে গেছে মেয়েদের সাজের অনুষঙ্গে।
হাতে পায়ে রক্তিম আভা দিয়ে অপরূপা করে তোলে এই বস্তু। হাল আমলেও অনেক বাঙালি মেয়ের আয়নার পাশের তাক থেকে এখনো উঁকি দেয় একশিশি আলতা।
সংস্কৃত ‘অলক্ত’ থেকেই এসেছে ‘আলতা’- নারীদের সাজের অভিজাত একখানি উপকরণ হিসেবে রয়ে গেছে বাঙলায়।
আগে গ্রামীণ পরিবেশে ঘরে ঘরেই আলতা পাতা হতো। এটি ছিল তিন ইঞ্চি পুরু লাল তুলো, যা পুটুলী করে কাপড়ের মতো ভিজিয়ে নিলেই সুন্দর লাল দাগ কাটা যেতো। এরপরে পানের পাতার রসে বা সিঁদুর গুলে আলতা তৈরি হতো। এখন হয় লাক্ষার নির্যাস বা বেঙ্গল রোজে নানা খনিজ উপাদান মিশিয়ে। আয়ুর্বেদ মতে, আলতা ব্যবহারে পায়ের হাজার রোগ সারে।
একটা সময় ছিল যখন সব বয়সী নারীরা আলতা ব্যবহার করতেন। একে এয়ো স্ত্রীর চিহ্ন মনে করা হতো। আজকের দিনেও রীতি মেনে দুধে-আলতায় পা ডুবিয়েই নববধূ গৃহে প্রবেশ করে অনেক বিয়েতে।
আলতার ব্যবহার বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশি দেখা গেলেও, কেউ কেউ যে নেহায়েতই শখ করে পড়েন আলতা। কাঠির মাথায় তুলো সেটে আলতায় ডুবিয়ে এখনো পা রাঙান অনেকেই, সাথে জড়িয়ে নেন নূপুর। শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীর সাজ, অলক্ত বিনে তো অপূর্ণ!
আগের দিনের রাজকুমারীদের এই আলতা পরবার জন্য রাখা ছিল আলতা দাসী। তারা পরম যত্নে নানা নকশা এঁকে সাজিয়ে দিতো রাজবালার কোমল চরণ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সে যুগে পুরুষরাও আলতা ব্যবহার করতেন। আলতার তুলিটির নাম ছিল ভারী চমৎকার - আলতানুটি। এই আলতার সাথে রোমান্টিসিজমের সুন্দর যোগ রয়েছে। কাব্যে প্রেমিক তার হৃদয় রঞ্জন দিয়ে আলতা পরিয়ে অভিমানী প্রেমিকার মান ভেঙে দিতে চায়।
কলকাতার বেশ জনপ্রিয় একটি আলতার ব্র্যান্ড ‘রাঙ্গাজবা।’ যেটি শুরু হয়েছিল নব্য স্বাধিকার চেতনা বিশ্বাসী, বাংলাদেশের ফরিদপুরের সন্তান দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠাকল্পে।
আলতা বাঙালির সংস্কৃতিকে রাঙিয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। শারমিম রিমতি গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। যখন কোনো নিরালা অলস দুপুরে তার কিশোরী মন জেগে ওঠে, ছোট বাটিতে করে তিনি পা সাজাতে বসে যান, ছবি তোলেন আর নিজেকে সেকেলে নায়িকাদের মতো ভেবে মনে মনে খুশি হন।
“আলতার সাথে পরিচয় খুব ছোটবেলায়, মায়ের ড্রেসিং টেবিলে। সেসময় আলতাকে সাজসজ্জার সামগ্রী হিসেবে চিনলেও ব্যবহার করা হয়নি। মাকেও খুব ঘন ঘন আলতা পড়তে দেখিনি। এরপর আলতা আর আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে যখন আলতা ইদ উপহার হিসেবে পাই বাবার কাছ থেকে।”
ছোটবেলায় আলতা ছিল শারমিনের খেলার জিনিস। কিন্তু এখন তা পরিণত হয়েছে শখে, সৌন্দর্যের শখ পূরণের অনুষঙ্গে।
“প্রতিদিনই কারণে অকারণে চলতে থেকে পায়ে – হাতে আলতা ঘষা আর সারা বাড়ি ছোটাছুটি। বিছানায় রঙ ওঠা নিয়ে মা ঈষৎ বিরক্ত হলেও মেয়ের শখের কাজে বাধা দেননি কখনোই। এরপর থেকে ইদ মানেই বুঝতাম মেহেদি আর আলতা। এছাড়াও গ্রামের বাড়ির জ্যৈষ্ঠ মেলায় গিয়েও আলতা কেনা চাই-ই।”
রিমতির মতো শখের বশে আলতারাঙা পায়ের চল আজো রয়ে গেছে, নববধূর সাজেই শুধু নয়, কিশোরী-তরুণীদের হালের ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও।
সুস্মিতা রায় দিবা বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
susmi9897@gmail.com
